নরক

-নিলয় ঘোষ (৬ নভেম্বর, ২০১৮)

এক, দুই, আড়াই, আর এই চেকমেট। দেখ হেরে গেলি তোহ! “পাগল ছেলে!, তুই যেটা দিলি ওটাকে আড়াই নয় সাড়ে তিন বলে।“ এই কথা বলে আবির তো হাসলোই ,তার সাথে পাশে যারা ছিল তারাও হো হো করে হেসে উঠল।আজ রবিবার, এখানে এই দিন জমিয়ে দাবা খেলা হয়। খুব কম লোক ই আছে, যারা আবির কে কিস্তিমাত করতে পারে, আর তাদের মধ্যে একজন হল আয়ুষ। সে এখনো এসে পৌছাইনি, তাই আবির পটলা কে খেলা শেখাচ্ছিল। তা অবশ্য নিছক ই আনন্দের জন্য। আবির জানে পটলা খেলা শিখতে পারবেনা বা শেখার কোনো ইচ্ছাও নেই। এইভাবে কিছুক্ষন হাস্যরসিকতা চলার পর আয়ুষ মহাশয় এলেন। একেবারে ছাড়া গরুর মতো হন্তদন্ত করে এসে পটলা কে এমন ভাবে সরিয়ে নিজে বসে পড়ল যেন ওখানে কেউ ছিল ই না। “আরে বাবা এত বার ফোন করার কি আছে? আসতে সময় লাগে তো নাকি?” আবির কে বলল আয়ুষ।“ফোন? তোকে কেন ফোন করতে যাব?” উত্তর দিল আবির। “তোর কলেই তো আমার ঘুম ভাঙল।এই দেখ ৬ টা মিসড কল।“ফোন টা পকেট থেকে বের করে দেখাল আয়ুষ। “যায় হোক! ওসব বাদ দে! একটা ইন্টারেস্টিং নিউজ আছে।“ আবার বলল আয়ুষ। “কি নিঊজ?” দাবার ঘুটি সাজাতে সাজাতে জিজ্ঞাসা করল আবির। “নেক্সট VLOG এর জন্য জায়গা ঠিক করে ফেলেছি” আয়ুষের উত্তর। এখানেই বলে রাখি আয়ুষ রিসেন্টলি ইউটিঊব এ Vlogging শুরু করেছে। vloggingকালচার টা দেশের ভিতর ছড়িয়ে পড়লেও, বাংলাতে এখনো ঠিকঠাক আসেনি। আয়ুষ বিভিন্ন জাইগায় ঘুরে ভিডিও বানায়, মাঝে মাঝে সেলফি স্টিকের মাথাই ক্যামেরা লাগিয়ে নিজে নিজেই কি সব বকে, আর তা আপলোড করে। আর তার সাথে এইসব করতে আবির কেই যেতে হয়। না গিয়ে উপায় ও নেই, বেস্ট ফ্রেন্ড বলে কথা! “তা এবার কোথাই জেতে হবে শুনি?!” প্রশ্ন করল আবির। “আটলান্টিস! যাবি নাকি? “হ্যা সেই ভালো, এখন নাকি সাবমেরিনে ৫০% অফ দিচ্ছে, ঘুরে আসাই ভাল।“ “হেঃ হেঃ! এটা হল জল ছাড়া আটলান্টিস। কাল রাতে নতুন জায়গা নিয়ে কথা বলছিলাম বিমু দার সাথে, তখন ই সাজেস্ট করল। VLOG এর জন্য এক্কেবারে পারফেক্ট জায়গা, লোকজন ও খুব কম যায়, যে কয়েকজন যায় তাও আবার পিকনিক সিজনে। “হ্যা ঠিক আছে, কিন্তু জায়গা টা কোথায়? আর এর সাথে আটলান্টিসের সম্পর্ক কি?”বলল আবির। “ হুম, মিল তো আছেই, আটলান্টিস যেমন সমুদ্রে মিলিয়ে গিয়েছিল, এও তেমনি মিলিয়ে গিয়েছিল। তবে তা সমুদ্রে নয় হাওয়ায়। বিমু দা আগের বছর পিকনিকে গিয়েছিল।যে ভিডিও গুল সেন্ড করেছিল তা দেখে মনে হল, হিস্টোরিক প্লেস। সিনেম্যাটিক শটস গুল দারুন হবে। “ আয়ুষ বলল। “ আর হাওয়াই মিলে গিয়েছিল মানে টা কি?” আবার প্রশ্ন আবিরের। “জায়গাটার নাম নক্ষত্রগড়, আশেপাশের লোকজন বলে মহামারি লাগার পর নাকি সব মানুষজন এলাকা ছেড়ে যায়, আর তার পড় থেকেই ওভাবে পড়ে আছে।“ বলল আয়ুষ। “নক্ষত্রগড়? এটা কোথায়?” “এখান থেকে ট্রেনে ৮ ঘন্টা লাগবে।“ এইসব কথাবার্তা আয়ুষ আর আবিরের মধ্যে চলতে থাকে, আর তার সাথে সাথে খেলাও।কাল বেরনোর জন্য সব প্ল্যানিং করে নেয় তারা। এখন সকাল ৬ টা। ব্যাগ গুছিয়ে ক্যামেরা, ট্রাইপড, ড্রোন নিয়ে রেডি আয়ুষ। স্টেশনে এসেছে ১০ মিনিট।কিছু সময় পর আবির ও এসে গেল। “তুই প্রতিবার ই লেট করিস।“ খানিকটা বিরক্ত হয়েই বলল আয়ুষ।“ “রাস্তাই বিভৎস জ্যাম ভাই!” “আচ্ছা ঠিক আছে বুঝেছি, এবার চল!” সামনে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে একটা চায়ের স্টলে বসল দুজন। সেখান থেকে দুধ চা আর পরোটা খেয়ে নিল। ৭ টাই ট্রেন আসবে। কোনো লোকাল ট্রেন চলেনা বলেই স্টেশন ফাকা আছে। জানলার ধারের সিট পেয়ে গেল তারা, এতে দুজন ই খুশি। প্রায় ৮ ঘন্টার জার্নি। কিন্তু সমস্যা হল এত সময় কাটবে কি করে? এক এ অপরের মুখ চাওয়া চায়ি করে শেষে ফোন বের করে পাবজি খেলা শুরু করে । ট্রেন এসে থামল গন্তব্য স্টেশনে।“ তাড়াতাড়ি যেতে হবে ভাই! আলো থাকতে থাকতে কিছু শট নিতে হবে।“ বলল আয়ুষ। স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটা অটোরিক্সা নিয়ে মোটামুটি ৩০ মিনিট পরে তারা নামল। “ শেষমেস উই আর ইন নক্ষত্রগড় ব্রো!” ভাড়া মিটিয়ে উচ্ছসিত হয়ে আবির বলল। পুরোপুরি গ্রাম্য জায়গা, বাড়ি সংখ্যা ও খুব কম। বিমু দার কথা মতো এই ইটের রাস্তা ধরে মিনিট দশেক হাটলেই তারা পৌছে যাবে সঠিক স্থানে। এর মধ্যে আয়ুষ ভিডিও করা শুরু করে দিয়েছে। কিছুখন পর সন্ধ্যে হয়ে যাবে, গাছপালার সংখ্যা একটু বেশি। মাঝে মাঝে উচু উচু ঢিবি, আবার পাথুরে জমিও দেখা যাচ্ছে। আরেকটু ভিতরে গেলে দেখা যায় পরিত্যাক্ত বাড়ি, কোনোটাকে বটগাছ গ্রাস করেছে তো কোনোটা ভেঙ্গে পড়ছে। “কতদিন ধরে এরকম খালি পড়ে আছে বলত?” আয়ুষ কে প্রশ্ন করল আবির। “ অনেক দিন! নেহাত পাথর দিয়ে তৈরি, তাই টিকে আছে এখনো নাহলে জঙ্গল ছাড়া হয়ত কিছু থাকতনা।“ আয়ুষের উত্তর। তারা ঘর গুলিতে ঢুকে ঢুকে দেখছিল, বেশ কিছুটা এগোনোর পর, তুলনামূলক বড়ো ঢিবির মতো ঘর দেখা গেল। কাছে যাওয়ায় বোঝা গেল এটাও ঘর কিন্তু উপরে মাটি জমে গাছপালা জন্মিয়েছে। ঘরের দরজাটা একটু উপরে, সিড়ী দিয়ে উঠতে হবে। তারা সন্তর্পনে উপরে উঠল। পাথরগুলো খুব ই পিচ্ছিল। ভিতর টা অন্ধকার, আশ্চর্যের বিষয় ভিতরে কোনো জানালা নেই। দরজা দিয়ে যা আলো আসছিল তা খুব ই অল্প, সন্ধ্যা হয়ে আসছে। “সাপ বা পোকামাকড় থাকতে পারে, ফোনের ফ্ল্যাশ টা জ্বালা।“ আয়ুষ কে বলল আবির। আয়ুশ ফ্ল্যাশ টা জ্বালালে ঘরের ভিতর টা একটু ভাল করে দেখা গেল। সারা দেওয়ালে খোদাই করে বিভিন্ন নকশা করা, যা আগের ঘর গুলোতে ছিল না। একটি দেওয়ালে আবার বড় করে সুর্যাকৃতি চাকার মতো কিছু খোদাই করা। ঘরের একটা কোনায় গর্ত সদৃশ কিছু দেখা যাচ্ছে। তারা কাছে এগিয়ে গেল। গর্ত নয় তবে একটা সিড়ি নীচের দিকে নেমে গিয়েছে। “ আয়ুষ! এর নীচে আরেকটা ঘর আছে!” আবির কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠে। একে একে তারা নেমে যায় নীচের ঘরে। নীচে নেমেই সর্বপ্রথম তাদের যা চোখে পড়ে তা হল বিশালাকার এক মুর্তি। এরকম মুর্তি তারা আগে কখনো দেখেনি। “এটা কি কোনো মন্দির ছিল?” প্রশ্ন করল আবির। তার এইরকম প্রশ্ন স্বাভাবিক, কারন দেব দেবীর মুর্তির সাথে এর মিল আছে। একটা বেদি ধরনের কিছুর উপর সেই মুর্তির অবস্থান। তারা মুর্তি টাকে বেশ খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছিল। এমন সময় বেদির কাছে চাকার মতো কিছু দেখতে পেল আয়ুষ। একটা নয় পাঁচ্টা। একটির ভিতর আরেকটি, তার ভিতর আরেকটি, এভাবে সর্বমোট পাঁচটি। সেটা ভালো করে পর্যবেক্ষন করার জন্য সে বসে পড়ল। “ এদিকে আয় আয়ুষ, দেখ কি খুজে পেয়েছি!” আয়ুষকে ডাক দেয় আবির। কিন্তু আয়ুষ তার কথায় কান দেয় না,আয়ুষ চাকা গুল নিয়ে ব্যস্ত। আয়ুষ দেখতে পায়, চাকা গুলোর উপর খুদ্র খুদ্র দাগ কাটা আছে। চাকা গুল ঘোরে কিনা দেখার জন্য সে একটা চাকা কিছুটা মোড়া দেয়। মোড়া দেওয়ার ২ সেকেন্ডের মধ্যে আয়ুষের পায়ের তলা কাপতে শুরু করল। ইলেক্ট্রিক জেনারেটরের আওয়াজ কে চাপা দিলে যেরকম শোনায় ঠিক সেরকম একটা আওয়াজ। মুহুর্তের মধ্যে আবিরের চিৎকার ,চিৎকার টা এমন ভাবে থামল যেন স্পিকারের ভলিউম কেঊ হঠাৎ করে কমিয়ে দিল। আয়ুষ বিদ্যুৎ বেগে উঠে দাড়াল। মুর্তির চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে, ক্ষীন বেগুনী আভা চোখে। আয়ুষ জোরে ডাক দিল “আবির!”।কোনো উত্তর এলনা। সারা ঘরে আবির কোথাও নেই, আয়ুষের চোখে মুখে আতংকের ছাপ। সে তার হৃৎপিন্ডের কম্পন সারা শরীরে অনুভব করতে পারছে। ছুটতে ছুটতে সে উপরের ঘরে উঠে গেল, নাহ! এখানেও আবির নেই । ঘর থেকে বেরিয়ে গেল আয়ুষ, বাইরেও সে নেই। কিছুক্ষন চুপচাপ থাকার পর নিজেকে শান্ত করল আয়ুষ। আবার সেই নীচের ঘরে গেল। এতক্ষনে মাটির সেই কম্পন থেমেছে। মুর্তির চোখ ও আগের মতো অবস্থায়। আয়ুষ চাকাটি আগে যেমন ছিল , মুড়িয়ে ঠিক তেমন করে দিল। আবার সেই এক ই দৃশ্য, আবার সেই কম্পন, এর মধ্যে হাপাতে হাপাতে আবির মুর্তির পিছনের অন্ধকার থেকে আয়ুষের দিকে এগিয়ে আসল। আবির কে দেখতে পেয়ে উত্তেজিত হয়ে আয়ুষ জিজ্ঞাসা করল “ কোথায় ছিলিস? কি হয়েছিল?” “ আমার ও তো সেই এক ই প্রশ্ন! তুই কোথায় ছিলিস?” আবির বলল। “ আমি তো এই ঘরেই ছিলাম! আর তোকেই খুজছিলাম! তুই একটু খুলে বলত কি ঘটেছিল?” আয়ুষ বলল । “আমি মুর্তির পিছন দিকটাতে ছিলাম, মুর্তির পিছনে পায়ের দিকটাই একটা গর্ত আছে। ওটাই দেখতে পেয়ে তোকে আসতে বলি, গর্তটার ভিতর টা দেখার জন্য আমি নীচে নেমে যাই। প্রায় ৭ ফুটের কাছাকাছি গর্ত। হঠাত আমার মাথা টা ঘুরে ওঠে, চোখ খুলে দেখি আমি এই ঘরের বাইরে। ভিতরে এসে তোকে খুজি, কিন্তু কোথাও পাচ্ছিলাম না, নীচের ঘর, উপরের ঘর কোথাও ছিলিস না। তোকে কল ও করি, রিং হচ্ছিল কিন্তু তুই রিসিভ করছিলিস না। তারপর হঠাৎ ই দেখি আমি ওই গর্তের ভিতর। কি হচ্ছে আমি কিচ্ছু বুঝছিনা” আবির উত্তর দিল। আয়ুষ একবার গর্ত টা দেখল। আশ্চর্য ব্যাপার! এরকম গর্তের কারন টা কী? এসব ভাবতে ভাবতে আয়ুষ কল লিস্ট টা চেক করল, কিন্তু সেখানে আবিরের কোনো কল নেই। “ আচ্ছা আবির! আমার ফোনে কাল তোর কল, কিন্তু তুই ফোন করিসনি, আজ বলছিস তুই কল করেছিস, রিং হয়েছে! আমার ফোনে কোনো কল আসেনি। কিছু তো গন্ডোগোল আছেই! তুই যখন বাইরে ছিলিস তখন সুর্যের আলো কতটা ছিল?” প্রশ্ন করল আয়ুষ। “ আলো? হ্যা অনেক আলোই ছিল। কিন্তু কেন?” আবিরের উত্তর। “ ইয়েস! যেটা ভাবছিলাম সেটাই হয়েছে!” “কী হয়েছে?” “তুই অতীতে চলে গিয়েছিলিস।“ “অতীতে? মানে? কীভাবে!” “আজ করা তোর কল ই কাল সকালে আমার ফোনে ঢোকা কল।“ আবিরের অবর্তমানে সেখানে কি কি ঘটেছে সেগুল আয়ুষ আবির কে বলে। সব টুকু সোনার পর আবির জিজ্ঞাসা করে এগুল যদি সত্যি হয় , তাহলে এই জিনিস শতাব্দী প্রাচীন এই পরিত্যাক্ত মন্দিরে কি করছে? “এই সব কিছুর উত্তর আমাদের খুজতে হবে, আবির! আমাদের সেই সময় যেতে হবে, যখন নক্ষত্রগড়ে মানুষ বাস করত। এই মুর্তি বা যন্ত্র যা ই বলিস, তোকে কাল সকালে পাঠিয়েছিল। মানে ৩৩ ঘন্টা আগে।“ এই কথা বলে আবির চাকা তে কাটা দাগ গুলো বোঝার চেষ্টা করে, সে এর আগে কত দাগ পর্যন্ত ঘুরিয়েছিল তার সাহায্যে কত টুকু ঘোরালে কত সময় অতীতে যাওয়া যায় তার একটা অনুমান করে নিল। যে ছেলে দাবা খেলার সময় আগামী ৯ চাল পর্যন্ত সমস্ত প্রোবাবিলিটি, পসিবিলিটি ক্যাল্কুলেট করে নিতে পারে, তার এরকম কাজ দেখে আবির অবশ্য খুব বেশি অবাক হয়নি। আবির ঢুকে যাই সেই গর্তের ভিতর। বেশ কয়েকবার ব্যার্থ্য চেষ্টার পর আবির কে সঠিক সময়ে পাঠাতে পারে আয়ুষ। আবির এখন অতীতে, নক্ষত্রগড়ে, তবে কয়েকশ বছর আগের সময় এখন। ওই তো সেই মন্দির ! একটু দূরে কোথা থেকে মানুষের বিশাল কোলাহল শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে হাজার মানুষ একসাথে হয়েছে। আবির সেই দিক লক্ষ্য করে এগিয়ে যায়। যত এগোচ্ছে তত মানুষের চিৎকার বাড়ছে। তার সাথে সাথে ঢাকের আওয়াজের মতো কিছু শোনা যাচ্ছে। হয়তো কোনো উৎসব হচ্ছে, আবির ভাবল। কিছুদূর এগোনোর পর আবির পৌছাল সেই বিশাল জনসমাবেশের মধ্যে। সবাই গোল হয়ে দাড়িয়ে আছে। মাঝখানে বিশাল অগ্নিকূন্ড , আবার তাকে ঘীরে ৮,৯ টা লোক অদ্ভুদ এক বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে। তবে আবির যা দেখে সব থেকে বেশি অবাক হল, একটি মেয়ে। ১৬ কিম্বা ১৭ বছর বয়সের একটি মেয়ে। তাকে পিঠ মোড়া দিয়ে হাত বেঁধে রাখা হয়েছে, ২,৩ টি স্ত্রী লোক তাকে ধরে রেখেছে। আরেক জন তার মাথায় জল ঢালছে। আবির আরো এগিয়ে গেল, মেয়েটার চোখ মুখ ফুলে গিয়েছে। মাঝে মাঝে সে ফোপাচ্ছে! অনেক কান্নার পর যেমন টা হয় ঠিক তেমন। আবির লোক জন দের দিকে তাকাল। তারা যেন খুব খুশি, ছখে মুখে আনন্দের ছাপ। এ কেমন উতসব! আবির ভাবতে লাগল! মেয়েটাকে এবার ওঠানো হল। এক মধ্যবয়স্ক লোকের পিছন পিছন মেয়েটাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তার পিছনে বাদ্যযন্ত্র নিয়ে লোকগুল, কিছু সাধারন মানুষ ও পিছন পিছন যাওয়া শুরু করল। তাদের সাথে আবির ও। মেয়েটাকে মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কি ঘটতে চলেছে তা দেখার জন্য তাদের সাথে কোনমতে প্রবেশ করল আবির মন্দিরের ভিতর।মেয়েটাকে নামানো হল সেই নিচের ঘরে। মশালের আলোই মুর্তি টাকে এবার স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কি বীভৎস চেহারা। কিছুক্ষন ধর্মীয় রিতীনিতী চলার পর, তাকে জোরপূর্বক ওই গর্তের ভিতর ঢোকানোর চেষ্টা চলছে। তার আর্তনাদ বাজনার কাছে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। গর্তের ভিতর ঢুকিয়ে মধ্যবয়স্ক লোকটি বেদির কাছে চাকা গুলি ঘোরালো। এরপর আর শোনা গেল না মেয়েটার কান্নার আওয়াজ। সবাই এবার চুপ। বাজনাও বন্ধ হয়ে গেল, লোকটি চাকা টি ঘুরিয়ে আগের জাইগায় আনল, কিন্তু মেয়েটি ফিরলনা। সবাই এবার আস্তে আস্তে বের হয়ে যাচ্ছে, আবির ও বের হয়ে গেল । চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই সে মুর্তির পিছনে এসে পৌছাল। “ কি রে ঠিক আছিস তো?” প্রশ্ন করল আয়ুষ। আবিরের কাছ থেকে যাবতীয় ঘটনা শোনার পর, ওই লোকটার মতো এক ই রকম ভাবে , আবির কে পাঠিয়ে দিল মেয়েটার কাছে, তার সাথে কথা বলতে। সেখানে পৌছানোর সাথে সাথে আবিরের সারা দেহ জ্বলে উঠল, গরমে। হঠাত করে এসি থেকে বেরলে যেমন টা হয়। অসম্ভব গরম, মাটি থেকে যেন বাষ্পের ভাব উঠছে। কিছু সময় খোজার পর মেয়েটাকে দেখা গেল। একটা পাথরের নীচে আধশোয়া হয়ে বসে আছে। আবির তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল “এটা কোন জায়গা?”উত্তরে মেয়েটা ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলল “নরক! কেন তুমি জাননা? কি পাপ করেছ তুমি যে এখানে আসতে হল?” আবির ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলনা, তবে কেন আর কিভাবে এখানে এসেছে তা সবটা বলল। সব শোনার পর মেয়েটি বলল “ কিছু বছর আগে আমাদের গ্রামে একদল মানুষের আবির্ভাব ঘটে। তারা সাধারন মানুষ দের থেকে আলাদা ছিল, তাদের কাছে অলৌকিক ক্ষমতা। এই অপরিসীম ক্ষমতা দেখে সাধারন মানুষ তাদেরকে দেবতার দূত বলে মানা শুরু করে। তাদের রাজা বানানো হয়। বানানো হয় মন্দির, মুর্তি। মানুষের উপর নৃশংস অত্যাচার, তারা বেধে দেয় কঠোর নিয়ম। সেগুলো নাকি দেবতাদের নিয়ম, আর তার লংঘন করলে হবে কঠোর শাস্তি, নরকবাস। ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে, দেবতার নির্দেশে পাপী মানুষদের পাঠানো হত নরকে,ঠিক আমাকে যেভাবে পাঠানো হল। কিন্তু এসব সব ই মিত্থ্যা, তারা কোনো দেবতার দূত নয়। কেবল তাদের কাছে আছে উন্নত প্রযুক্তি, আর তা ব্যাবহার করেই আমাদের গোলাম বানিয়ে রেখেছে ধর্মের নামে। যে মুর্তির মাধ্যমে তুমি এখানে এসেছ, সেটা কোনো দেবতা নয়, একটা জ্বলজ্যান্ত মেশিন। ওই যন্ত্র ব্যাবহার করে যাওয়া যায় যে কোনো স্থান – কালে, যে কোনো সময়ে, মহাবিশের যেকোনো স্থানে। জানিনা এটা কোন গ্রহ, কোথায় অবস্থিত, যেটাকে তারা নরক বলে চালাচ্ছে।“ কিছুক্ষন চুপ থাকার পর মেয়েটি আবার বলল “চারপাশে একটু তাকাও, মৃতদেহ গুল দেখতে পাচ্ছ?” আবির এবার ভাল করে খেয়াল করল, বেশ কয়েকটি মৃতদেহ । কোনোটার কংকাল বেরিয়ে গিয়েছে, তো কোনোটা আস্ত। শিঊরে উঠল আবির। “এখানে ঘন্টাখানেক থাকলেই তাপমাত্রার কারনে মারা যাবে। যাই হোক, আমি ওদের ব্যাপারে জানতে শুরু করি, তাদের কিছু বই ও চুরি করেছি। বছর খানেক চেষ্টার পর সব টা জানতে পারি, সবাইকে জানাই কিন্তু কেঊ বিশ্বাস করেনা। কিভাবে এই অত্যাচার বন্ধ করা যাই তার উপায় বার করতে থাকি। তারা আমার সম্পর্কে জেনে যায়, ফল হিসাবে আমাকেও এখানে পাঠানো হল।“ আবির জিজ্ঞাসা করল,”কিভাবে আটকাতে তাদের? “মন্দিরের উপরের ঘরে সুর্যাকৃতি এমারজেন্সি হুইল আছে। এটা তারা বানিয়েছিল বিপদকালীন পরিস্থিতি তে ব্যবহার করার জন্য। হুইল টা ঘোরানো মাত্রই তারা ফিরে যাবে, আর সমস্ত সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, তৈরি হবে শক্তিশালী ব্যারিয়ার। তাদের বইতে কোনো এক জায়গায় পড়েছিলাম এই যন্ত্রের নাম নাকি ভ্যারিয়েবেল আইন্সটাইন-রোজেন ব্রীজ.........” মেয়েটি তার কথা শেষ করতে পারেনা, তার আগেই আয়ুষ আবির কে ফিরিয়ে আনে বর্তমান সময়ে। আয়ুষ সবটা শোনার পর আনন্দে লাফিয়ে ওঠে...”এতক্ষনে সবকিছুর মধ্যে লিঙ্ক করতে পেরেছি।“ তাদের আর বুঝতে বাকি থাকলনা তাদের এখন কি করনীয়। আবির অতীতে গিয়ে সুযোগ বুঝে হুইল টি ঘুরিয়ে দিয়ে ফিরে আসে। এর ফলে অত্যাচারীরা তো ফিরে যায়, কিন্তু কোনো এক অজানা কারনে নক্ষত্রগড়ের সমস্ত লোক কোথায় যেন হাওয়া হয়ে যায়। “ এখন ১০ টা বাজে, ১১ টা ৩০ এ ট্রেন! আমাদের এখনি বেরতে হবে। আশা করি অটো রিক্সা পেয়ে যাব।“ আয়ুষ বলল। “কিন্তু এই যন্ত্রের কি হবে?” “পরে এসে দেখা যাবে, এখন চল।“ আবির আর আয়ুষ নক্ষত্রগড় ছেড়ে বেরিয়ে যায়। কিন্তু আবির নিজেও জানেনা, নক্ষত্রগড় এর আটলান্টিস হয়ে যাওয়ার পিছনে দায়ী তার ই কোনো ভুল।