ভাইরাস ১.৬১৮

-নিলয় ঘোষ (১২ এপ্রিল, ২০১৯)

ফেসবুকের নিউজ ফীড স্ক্রল করছিলাম বসে বসে। সুভাষের টেক্সট আসল, তাতে লেখা ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার ২০৩৬‘। উপরে ফরওয়ার্ডেড লেখাটা দেখে হাসি পেল। ওহ! ১২ টা বেজে গেল? এবার মেসেজের বন্যা বয়বে। কিছুক্ষনের জন্য গা ঢাকা দেওয়ায় ভাল। এর মধ্যে পাশের ঘর থেকে হোস্টেলের বাকি বন্ধুরা বেরিয়ে এসে বলল, ‘কি রে প্রজিত, বাইরে বের হবিনা?’ এর মধ্যে বাইরে বাজি ফাটার শব্দ শুরু হয়ে গিয়েছে।‘তোরা বের হ। আমি একটু পর হচ্ছি।‘আমি বললাম। যা করবি কর , এই বলে ওরা চলে গেল। আসলে কিছুদিন ধরে যে ধকল গিয়েছে, বাইরে বেরতেই ভাল লাগছেনা। আপনার মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে কি এমন হয়েছে। আসলে, ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল দিন দশেক আগে। নাহ! আরেকটু আগে থেকে বলি, তাহলে ভাল বুঝতে পারবেন।সেদিন কি বার ছিল মনে নেই, বিকেলের ট্রেনে হোস্টেলে ফিরছিলাম বাড়ি থেকে। বেশ কিছুদিন বাড়িতে ছুটি কাটিয়ে মেজাজ টাও ছিল ফুরফুরে। তার ওপর জানলার ধারের সিট, হেডফোনে পছন্দের গান, পরিবেশ টা ভালোই উপভোগ করছিলাম। ট্রেন ফাকাই ছিল, কম্পার্টমেন্টে লোকসংখ্যা বড়জোর ১০ কি ১২। এই সময় টা এরকমই হয়।দুটো স্টেশন পরে কম্পার্টমেন্টে একটা লোক উঠল, আমার সামনে এসে ব্যাগ টা বাঙ্কারের উপর রেখে কি যেন একটা জিজ্ঞাসা করল। হেডফোনটা খুলে আবার শুনলাম। লোকটা বলল ‘আমি বসব এখানে?’ কথাটা শুনে আমি সামনের সিট এ রাখা আমার ব্যাগ টা নিজের কাছে তুলে নিয়ে বললাম, অবশ্যই। কম্পার্ট্মেন্ট খালি ছিল বলেই আর বাঙ্কারে তোলা হয়নি। লোকটা আবার বলল ‘ওখানে নয় তোমার এখানে।‘ আশ্চর্য তো! এ কেমন মানুষ।সারা কামরা খালি থাকতে আমার সিটে বসবে আমাকেই তুলে দিয়ে? মেজাজ টা ভাল ছিল ফালতু কথা বাড়িয়ে খারাপ করতে চাইলাম না। আমি উঠে গিয়ে সামনের সিটে গিয়ে বসি। লোকটাকে কেমন যেন দেখতে ছিল।হাইট শর্ট, গোলগাল চেহারা, হাত পা গুলো ছোটো ছোটো। ইন করে জামা পরা, তবে বেল্টের অবস্থান নাভির উপরে সেটা বোঝাই যাচ্ছিল। তার শরীরের আকৃ্তি যেন খাড়া করে বসানো উপবৃত্তের মতো। মাঝখানটা মোটা উপরের আর নীচের দিকে ক্রমশ সরু। আমি গান শুনতে শুনতে এইসবই দেখছিলাম,আর মাঝে মাঝে জানলার বাইরে তাকিয়ে পরিবেশ উপভোগ করছিলাম।লোকটা কিছুতেই স্থির হচ্ছিল না, কিছুক্ষন পর পর ই আমাকে নানান রকম প্রশ্ন করছিল। আমার অচেনা মানুষদের সাথে কম্ফোর্টেবলি কথা বলার অভ্যেস নেয়, তাই যথাসম্ভব কম শব্দে তার উত্তর গুলো দিচ্ছিলাম আর তাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। কখনো সে জিজ্ঞাসা করছে ‘কটা বাজে বলত?’ , যদিও তার নিজের হাতেই ঘড়ি রয়েছে। কখনও লাউড স্পীকারে গান চালিয়ে নিজেও তার সাথে গান করা শুরু করছে, আবার কখনো বিড় বিড় করে কি সব অস্পষ্ট ভাবে বকে যাচ্ছে। এসব কীর্তিকলাপ দেখে তাকে মানসিক ভারসম্য়হীন বলে মনে হয়নি একথা মিথ্যে নয়, কিন্তু তা নিয়ে বেশি ভাবিনি বা ভাবার ইচ্ছাও ছিলোনা। অবশ্য কিছুক্ষন পর ভাবতে বাধ্য হলাম। এক হকার উঠেছিল আমলকী বিক্রি করতে।অভ্যাসবসত এক প্যাকেট আমলকী কিনি। কেন জানিনা মনে হল আমাকে দেখেই সেই লোকটিও এক প্যাকেট কিনল। সে কিছুক্ষন খাওয়ার পর প্যাকেট টা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে ‘নাও খাও।“আচ্ছা মুশকিল তোহ!আমি যে একই জিনিস খাচ্ছি সে কি দেখতে পাচ্ছেনা?আমি বললাম,’না!আমি খাচ্ছি তো।‘ কিন্তু ভদ্রলোক কিছুতেই ছাড়বেনা।অবশেষে হার স্বীকার করে ভদ্রতার খাতিরে তার প্যাকেট থেকে একটা আমলকি তুলে নিলাম। নিতে না নিতেই লোকটা হাত বাড়িয়ে আমার প্যাকেট থেকে এক খাবলা তুলে নিয়ে মুখে পুরে দিয়ে এক গাল হাসি দিয়ে চিবতে চিবতে বলে।,’খাও খাও!’ ’বাপ রে। এরকম বদ্ধ পাগল আমি কখনো দেখিনি। এমন একটা সময় আসে যখন ট্রেনটা খুব ধীর গতিতে চলছিল।“দেখ এবার ইঞ্জিনটা থেমে যাবে” লোকটি বলল।আমি তার দিকে তাকালাম। কথাটা কি আমাকে বলল? মনে মনে ভাবলাম। তার দৃষ্টি আমার দিকে ছিল না।আর আমাকে তুই করে সন্মোধন করবে কেন? এতক্ষন তো তুমি বলছিল। এসব ভাবতে ভাবতে শুনলাম ইঞ্জিনের আওয়াজ টা বন্ধ হয়ে গেল। ওহ, বলাই হয়নি, আমরা ইঞ্জিন কম্পার্ট্মেন্টেই ছিলাম। বুঝলাম লোকটি নিত্যযাত্রী আর এখানেই হয়তো প্রতিদিন আওয়াজ বন্ধ হয়। কিছুসময় পর সে আবার বলল,’দেখবি এবার ক্রসিং হবে, আরেকটা ট্রেন আসবে।‘ এবার একটু কৌতুহল হল আমার। ততক্ষনে আমি নিশ্চিত সে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেনি। পাগলরা আপন মনেই অনেক কিছু বলে থাকে তবে এক্ষেত্রে একটু ভিন্ন। যেন মনে হচ্ছিল তার পাশে কেউ বসে আছে আর তার সাথে সে কথা বলছে। ‘আচ্ছা দাদা, বলছি কম্পিউটার শিখলে চাকরি হবে তো?’ এরকম আকস্মিক প্রশ্নে আমি হকচকিয়ে গেলাম। আমি উত্তর দিলাম হ্যা হবে। সে এবার বেশ উৎসাহিত হয়ে বলে,’দেখলি তো, তোকে বলেছিলাম না হবে।‘ তবে আমাকে নয়, আগের মতোই মনে হল কোনো অদৃশ্য ব্যাক্তিকে উদ্দেশ্য করে এই উক্তি। লোকটি আবার আমার দিকে তাকিয়ে বলে,’ আমাকে বলেছে কম্পিউটার শেখার পরে চাকরি দেবে।, তাই প্রতিদিন সকালে শিখতে যাই আর এখন আসি।‘ আমি বললাম ,’ওহ আচ্ছা!’ এরপর সে কোথায় যাবে, কোথায় কি করবে , কোথায় সে কম্পিউটার শেখে সে সব আমাকে বলতে থাকে। তার এই অনর্গল বকবকুনি শুনে একবার মনে হল সেখান থেকে উঠে অন্য সিটে গিয়ে বসি, কিন্তু তারপর ই ভাবলাম ব্যাপারটা খারাপ দেখাবে আর তাছাড়াও সে তো মজা করার জন্য বলছেনা, সে বিকারগ্রস্থ। যাই হোক আর কয়েকটা স্টেশন পরে সে নেমে গেলে আমি হাফ ছেড়ে বাচি। তারপর স্বাভাবিক ভাবে আমি হোস্টেলেও ফিরে যায়। সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। সামনে ফাইনাল এক্সাম।কলেজে আর ক্লাস হচ্ছেনা, মাঝে মাঝে প্রাইভেট টিউশন যাচ্ছি প্রাকটিস এক্সাম দিতে। বিপত্তি শুরু হল সেদিন সকাল থেকে। ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই মাথাটা অস্বাভাবিক রকমের ভার ভার লাগছিল। বিছানা ছেড়ে উঠতে গিয়েই মাথাটা ঘুরে গেল। ব্যালান্স হারিয়ে পরেই যেতাম যদি পাশের টেবিল টা না ধরতাম। একটু দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম এটা ভেবেই যে এখন শরীর খারাপ হলে পুরো কেলো হয়ে যাবে কারন সেদিন থেকেই আমার পরীক্ষা শুরু। তাড়াতাড়ি ব্রাশ করতে গেলাম , না হলে পৌছাতে দেরি হবে। আবার এক কান্ড! ব্রাশের আঘাতে দিলাম মুখের ভিতর টা রক্তাক্ত করে। শুধু তাই নয়, কোনো কাজই ঠিক করে করতে পারছিলাম না। জিনিসপত্র ধরতে গিয়ে পরে যাচ্ছিল, হাটতে অসুবিধা হচ্ছিল, আর মাথা ধরা টা তো ক্রমবর্ধমান। কোনোরকমে রেডি হয়ে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে পেটে দিয়ে গেলাম পরীক্ষা দিতে। উপযুক্ত সময়েই পৌছেছিলাম, নন-ইলেকট্রনিক্স এর এক্সপেরিমেন্টাল এক্সাম ছিল সেদিন। পরীক্ষক এক এক করে আমাদের ডাকল। তারপর টেবিলে বিছানো অনেক গুলি কার্ডের মধ্যে থেকে যেকোনো একটি তুলতে বলা হল। যে যেটা তুলবে তাকে সেই এক্সপেরিমেন্টটা করে দেখাতে হবে। এক্সপেরিমেন্ট নেওয়ার পর আমি ল্যাবে চলে গেলাম। ইকুইপমেন্ট সেট আপ করে রিডিং নেওয়ার চেষ্টা করলাম, পারলাম না। অস্বস্তির মাত্রা এত বেড়ে গিয়েছিল যে আইপিসে চোখ রেখে ফোকাস ও করতে পারলাম না। সামান্য ভারনিয়ার স্কেলের ঘর গুনতে আমার চোখ জ্বলে যাচ্ছিল। মাথা যন্ত্রনার পরিমান এত বাড়ল, একসময় তো চুল গুলো ধরেও টানছিলাম। মাঝে মাঝে আমি ভুলে যাচ্ছিলাম আমি কোথায় আছি, কি করছি। বিক্ষিপ্ত কিছু চিন্তা আমার মস্তিষ্ককে গ্রাস করছিল।যেন চোখ খোলা অবস্থাতেও আমি স্বপ্নের দৃশ্যের মতো কিছু দেখছিলাম। প্রচন্ড ভয় পেলাম। পা দুটো ভরহীন মনে হতে লাগল। এতটাই ভয় পেয়েছিলাম যে কিছু ভাবার মতো পরিস্থিতিতে আমি ছিলাম না। ইকুইপমেন্টস, খাতা সব ওইভাবে রেখেই আমি ল্যাব থেকে বেরিয়ে যায়। সোজা কলেজ থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি ধরি। এমন ভাবে আমাকে হাটতে হচ্ছিল যেন আমি দেড় বছরের বাচ্চা, সবে হাটা শিখেছি। ট্যাক্সিতে বসে ভাবলাম বাড়িতে একবার কল করি, তারপর ই খেয়াল হল তাড়াহুড়োতে আমি ফোনটা রুমেই ফেলে এসছি। খানিকবাদে অস্বস্তিকর অবস্থাটা একটু স্বাভাবিক পর্যায়ে পৌছাল। হঠাৎ করে বেরিয়ে না এসে কিছুক্ষন অপেক্ষা করলে হয়ত ভাল হত, কিন্তু তখন সেটা ভাবার ক্ষমতা আমার ছিলনা। হোস্টেলে পৌছাতে মিনিট দশেক লাগল। মানুষের হাটতে এত কষ্ট হতে পারে তা সেদিন প্রথমবার অনুভব করলাম।ঘরে ঢুকেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। গা হাত পা ছড়িয়ে একটু শান্ত হওয়ার চেষ্টা করছিলাম, এমন সময় আমার লাথি গিয়ে সজোরে লাগল খাটের শেষের কাঠে। লাথিটা অনিচ্ছাকৃত নয়, ইচ্ছাকৃত তো নয় ই। হ্যা, মনে হল কেউ যেন পা ধরে দুম করে খাটের সাথে সাটিয়ে দিল। এতক্ষন তো ট্রেইলার চলছিল, চরম ভয় তো তারপর লাগা শুরু হল।আমার সারা শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিজেই নিজের ইচ্ছা মতো নড়া শুরু করল। কখনো পা গিয়ে খাটে আবার কখনো হাত গিয়ে দেওয়ালে ধাক্কা মারছে! কি বিভৎস পরিস্থিতি! আমার নিজের উপর নিজের নিয়ন্ত্রন নেই। আমি জোর করে স্থির থাকার চেষ্টা করছিলাম। অদৃশ্য বল টা আমার সাথে লড়াই চালিয়ে গেল। মনে হচ্ছিল আমি কারো সাথে পাঞ্জা লড়ছি।আমি আরও জোর খাটালাম, ঘাড় ব্যাথায় ফেটে যাচ্ছিল।সেই ঘটনা আমি ভাষায় বর্ননা করতে পারবনা। তারপর যতদূর মনে আছে, একটা প্রবল বৈদ্যুতিক শকের অনুভুতি, আমার সমস্ত শিরা উপশিরা যেন দুমড়ে মুচড়ে গেল। আর কিছু মনে নেয়। তারপর যখন চোখ খুললাম, তখন আমি হাসপাতালের বেডে। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম সেটা বুঝতে পারলাম।পাশে হোস্টেলের বন্ধুরা দাঁড়িয়ে, এদিক টাই ঘাড় ঘোরাতেই অবাক হলাম! আরেহ! এ তো অনিন্দ্য কাকু। আমার বাবার বন্ধু,ছোটোবেলায় তাকে আমি ডাক্তারকাকু বলে ডাকতাম। আগে আমাদের বাড়ি প্রায়ই যেত। এখন যায়না তা না, খুব ই কম। এত বড় একজন ডাক্তার , সময় কোথায়? আনিন্দ্য কাকু কে দেখে আমি একটু স্বস্তি পেলাম।আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোর বাবাকে কল করেছি, কিছু সময়ের মধ্যে চলে আসবে। সকাল থেকে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরন দিলাম তাকে। তারপর থেকে নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা চলতে থাকে। এম আর আই, সিটি স্ক্যান, এন সি টি, ইএমজি, আরো কত কি! সারাদিন একঘেয়ে অবস্থায় ওইভাবে থেকে খুবই বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। কাকু ভিতরে এল, তার হাতে কতগুলি কাগজ। খুব সম্ভবত ওগুলো পরীক্ষার রিপোর্ট। রিপোর্ট কি এসেছে সেটা জানার জন্য ভীষন কৌতুহলী ছিলাম। আর এই তো গত বছরই সুপ্রিম কোর্ট নতুন আইন তৈরি করেছে, কোনো রোগী চাইলে, তার রোগ ও ট্রিটমেণ্ট এর বিষদ বিবরন তাকে জানানো বাধ্যতামূলক। কাকু ছোট একটা টুল টেনে নিয়ে আমার পাশে বসে বলল,‘বুঝলি প্রজিত! তোর একটা ভাইরাল ইনফেকশন হয়েছে। তবে এটা কোন্ ভাইরাস সেটা ঠিক শনাক্ত করা যাচ্ছেনা। আর এটা তোর পুরো সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমকেই আক্রমন করেছে’। ‘সুস্থ হতে কতদিন লাগবে?’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম। ‘ইনফেকশন ক্ষনস্থায়ী হলেও তার পরবর্তী যে প্রভাব পরেছে তা অনেক বিস্ময়কর, অন্তত আমার ক্যারিয়ারে এরকম কিছুর সম্মুখীন আমি হয়নি’ এই কথা শুনে তাকে আমি সাথে সাথে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেন?! কি হয়েছে?’ --‘তোর দেহে এখন দুটো মস্তিষ্ক। ভাইরাস টা নার্ভাস সিস্টেম কে বোকা বানিয়ে এমন কিছু পরিবর্তন ঘটিয়েছে যার ফলে দেহ নতুন ব্রেইন সেল তৈরি করতে বাধ্য হয়েছে। যার ফল স্বরূপ আরেকটি গৌন মস্তিষ্ক তৈরি হয়েছে।‘ --‘দুটো মস্তিষ্ক? কিন্তু এক ই দেহে দুটো মস্তিষ্ক কি ভাবে থাকতে পারে? এটা কি ভাবে সম্ভব?’ --‘এমন কোনো ঘটনা আগে ঘটেছে কিনা আমার জানা নেই, তবে মানুষের মস্তিষ্ক দুটি প্রধান অংশ নিয়ে গঠিত সেটা কি জানিস? --‘হ্যা, লেফ্ট হেমিস্ফীয়ার আর রাইট হেমিস্ফীয়ার। --একদম ঠিক। মজার বিষয় হল এরা কিন্তু প্রত্যেকে স্বাধীন,অর্থাত নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা এদের রয়েছে। যেমন বা হাত লেফ্ট হেমিস্ফীয়ার আর ডান হাত রাইট হেমিস্ফীয়ার এর নিয়ন্ত্রনে থাকে। কিন্তু কিছু ব্যাতিক্রম ও আছে যেমন কথা বলার ক্ষমতা নির্ধারিত হয় শুধুমাত্র লেফ্ট পার্ট দ্বারা। এই দুই হেমিস্ফীয়ার এক এ অপরের সাথে যুক্ত থাকে এবং সম্মিলিত হয়ে একটি পূর্নাঙ্গ মস্তিষ্ক হিসাবে কাজ করে। আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রে এটা প্রমানিত যে কোনো ভাবে যদি এই দুই অংশের মধ্যে সমন্নয় ধ্বংস হয় বা কৃত্রিম ভাবে তা করানো হয়, তাহলে তারা সত্যি সত্যি ই দুটো আলাদা মস্তিস্ক হবে এবং দুটি পৃথক পার্সোনালিটি হিসাবে কাজ করবে। মানে বলতেই পারিস এক ই দেহে দুটো মন। তারা সর্বক্ষন পরষ্পরের সাথে প্রতিযোগীতায় মেতে থাকবে শরীরের উপর আধিপত্য বিস্তারের জন্য। সেক্ষেত্রে এমনও হতে পারে ব্যক্তি ডান হাত দিয়ে খেতে যাচ্ছে, হঠাৎ তার বাম হাত আঘাত দিয়ে খাবারটা ফেলে দিল। সবসময় খারাপ কিছু হবে এমন ও না। অনেক অসম্ভব ও সম্ভব হতে পারে, যেমন ধর দুই হাত দিয়ে দুটি আলাদা ছবি একসাথে নিখুত ভাবে একে দেওয়া, আরো অনেক কিছু। সেগুল নির্ভর করবে তারা পরষ্পরের সাথে কি ভাবে রিয়্যাক্ট করছে তার উপর। ‘আমারও কি এমন কিছু হয়েছে?’ আমি বললাম। ‘না এমন নয় তবে অনেকটা এমন। ওই যে বললাম পৃথক আরেকটি মস্তিষ্ক তৈরি হয়েছে, আর তার ফলেই সকাল থেকে তোর সাথে এগুল ঘটেছে।‘ কাকু উত্তর দিল। পরদিন সকাল বেলায় বাবা,মা এসে পৌছায়। তাদের সাথে বেশিক্ষন কথা বলতে দেওয়া হয়নি। চিকিৎসা চলা কালীন আমাকে বেশিরভাগ সময় অচেতন করে রাখা হত। অনিন্দ্য কাকু পরে জানায়, ভাইরাস টা কোনো আরএনএ ভাইরাস। একটু চিন্তিত হয়ে বলে,’তবে প্রজিত, ভাবার বিষয় হল ভাইরাস টা জেনেটিকালি মডিফায়েড।‘ ‘তার মানে...’ আমি কথা শেষ করার আগে কাকু আবার বলে,’হুম, তারমানে এটা মানুষের সৃষ্ট ভাইরাস। আমাকে প্রথম যখন পরীক্ষা করা হয়েছিল তখন গৌন মস্তিষ্কটির মানসিক বয়স ছিল সদ্যজাত কোনো শিশুর ন্যায়, কিন্তু সেই মুহুর্তে তার মানসিক বয়স ৪ বছরের বাচ্চার কাছাকাছি। এত দ্রুত বৃদ্ধি দেখে কাকুও অবাক হয়েছিল। তারপর আর বেশি কিছু মনে নেই। পরে যখন সচেতন অবস্থায় আসি তখন জানতে পারি,আমার সার্জারি কম্পিলিট। অবস্থা বেগতিক দেখে গৌন মস্তিষ্কটি কেটে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সেটাকে গবেষনার উদ্দ্যেশে সংরক্ষন করে রাখা হয়, তাও আবার জীবিত অবস্থায়। আমার কিছু বন্ধুরাও এসছিল দেখা করতে। কাকু বলেছিল, আমাকে আর মাত্র দুদিন পরই ছাড়া হবে। বাবার সাথে কথা বলে জানতে পারলাম,সেদিন সকাল থেকে যে সমস্ত নতুন রোগী ভর্তি হয়েছিল, তার আশি শতাংশ ই ওই ভাইরাসে আক্রান্ত।পরে কাকুও এক ই কথা বলল। ভাইরাস টি ছোয়াচে ধরনের। খাবার থেকে, জল থেকে কিংবা সংস্পর্শ থেকেও ছড়াতে পারে। এটাই ভাবছিলাম যে, কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা এটা ইচ্ছা করেই ছড়াচ্ছে। কিন্তু তাদের লাভ টা কি? এর পিছনে অনেক বড় বিজনেস স্ট্র্যাটেজি কাজ করতে পারে। অনেক ওষুধের কোম্পানি আছে যারা ইচ্ছা করে নিজেদের তৈরি রোগ ছড়িয়ে দেয়।তার জন্য যখন ক্রমাগত লোক মরতে থাকে, তখনি তারা তাদের ভ্যাক্সিন, ওষূধ ইত্যাদি বাজারে আনে আর তা চড়া দামে বিক্রি করে।এই ঘটনা ইতিহাসে বহু বার হয়েছে। এটাও কি তাই? তাই যদি হবে তাহলে কোনো মারনরোগের ভাইরাস ই বানাতে পারত। এভাবে দেহে নতুন মস্তিষ্ক তৈরি করার পেছনে তাদের কি লাভ থাকতে পারে? আমার মাথায় সারাদিন নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল।আমার করারও অবশ্য কিছু ছিলনা। সার্জারিও কম্পিলিট, আমাকে অচেতন অবস্থায়ও থাকতে হচ্ছেনা। আমি কিভাবে সংক্রমিত হলাম? এমন কোনো আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে তো আমি আসিনি! আমার হঠাৎ করে মনে পড়ে গেল কিছুদিন আগের ট্রেনের ওই লোকটার কথা। তাহলে যাকে পাগল বলে মনে করেছিলাম সে আসলে এই ভাইরাসে আক্রান্ত?আমার স্পষ্ট মনে আছে সে আমার প্যাকেট থেকে আমলকী নিয়েছিল।সেটা যদি হয় , আমার সাথে যে ঘটনা গুলো ঘটেছে তার সাথেও তো ঘটা উচিত। ট্রেনে সেসব তো ঘটতে দেখলাম না! মনে মনে ভেবে নিলাম সেটা জানার জন্য এখান থেকে ছুটি হওয়ার পর তার সাথে আমাকে দেখা করতেই হবে। সে কোথায় কম্পিউটার শিখতে যায় সেটা সে বারবার বলছিল, তা আমার মনে আছে। হসপিটাল থেকে ছুটি পাবার পর আমি সেই দিনই বিকালে তার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়। সে যে স্থানের কথা বলেছিল সেখানে গিয়ে কোনো কম্পিঊটার প্রশিক্ষন কেন্দ্র তো পেলাম ই না উপরন্তু কয়েকজন স্থানীয় দের কাছে জিজ্ঞাসা করলে তারা বলে সেখানে কোনো কম্পিউটার প্রশিক্ষন কেন্দ্র নেয়। হতাশ হয়ে স্টেশন এর দিকে হাটলাম। আমার ভাগ্য ভাল ছিল। স্টেশনে ঢুকতেই লোকটার দেখা আমি পেয়ে যায়। একটা বেঞ্চে বসে ছিল, আগের মতই বিড় বিড় করে বকছিল। আমাকে সে চিনতে পেরেছিল কিনা জানিনা তবে আমি যা জিজ্ঞাসা করছিলাম তার উত্তর সে দিচ্ছিল। সে নাকি কম্পিউটার ক্ল্যাস করেই ওখানে বসেছিল। তার কাছ থেকে সব টা শুনে আমার চোখ কপালে উঠে যায়। সে যেখানে যায় সেটা কোনো প্রশিক্ষন কেন্দ্র হতে পারে না। আমি তাকে নিয়ে অনিন্দ্য কাকুর কাছে নিয়ে গেলাম।সেখানে গিয়ে আমার ধারনা যে সঠিক সেটা প্রমানিত হয়।লোকটি সত্যি ই সেই ভাইরাসের বাহক ছিল। এরপরে যথাযথ তদন্ত ও পুলিশি হস্তক্ষেপের পর, ওই প্রতিষ্ঠানকে ব্যান করা হয় ও তাদের আধিকারিক দের গ্রেফতার করা হয়। তারাই এই ভাইরাস তৈরি করেছিল।লোকটি যাকে কম্পিঊটার প্রশিক্ষন কেন্দ্র বলছে সেটা আসলে অত্যাধুনিক অবৈধ ল্যাবরটরি। সেখানে লোকটির মতো আরো অনেক কেই পাওয়া যায়, এরা ছিল টেস্ট অব্জেক্ট।সবার মধ্যে একটা বৈশিষ্ট্য সাধারন ছিল সেটা হল এরা সবাই ট্রেনের লোকটার মতো মানসিক ভারসম্যহীন ছিল। এর থেকে স্পষ্ট বুঝেছিলাম তারা শুধু এই নির্মম পাশবিকতার শিকার। কম্পিউটার শিখলে চাকরি দেবে এই প্রলভনই তাদেরে দেখানো হয়েছিল। লোকটাকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তুমি সবসময় কার সাথে কথা বল? উত্তরে সে বলেছিল তার বন্ধুর সাথে কথা বলে।তার বন্ধু নাকি সবসময় তার সাথে থাকে।“বাহ! এক ই শরীরে দুটো বন্ধুর বাস।“ মনে মনে বললাম। এতক্ষন যা বললাম তা শুনে আপনার গাঁজাখুরে গল্প বলে মনে হতেই পারে। তা নিতান্ত আপনার ব্যাক্তিগত ব্যাপার।ওহ! ওই দেখুন বন্ধুরা বাইরে বেরনোর জন্য আবার ডাকছে। এই ভাইরাস তৈরির পিছনে কি উদ্দ্যেশ্য ছিল, তারা কারা ছিল, ওই লোকটারই বা কি হল, সেসব এসে বলছি। ততক্ষন বসে ভাবুন।